December 23, 2024, 1:09 am
জাহিদুজ্জামান/
শুষ্ক মৌসুমে খাবার পানির সংকটে পড়েছেন কুষ্টিয়ার শহর এলাকার মানুষ। কুমারখালী, খোকসা ও ভেড়ামারা শহরে এ সংকট থাকলেও মূলত তীব্র হয়েছে কুষ্টিয়া শহরে। জল প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা-গড়াই নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং শহর এলাকায় ঘণ ঘণ সাব মার্সিবল পাম্প বসানোতে পানির স্তর নিচে নেমে এ সংকট তৈরি করেছে।
প্রায় তিন যুগ ধরে শুষ্ক মৌসুমে কুষ্টিয়া শহর ও এর আশপাশের এলাকায় সুপেয় পানির সংকট থাকে। মার্চের শেষ দিক থেকে সাধারণ নলকূপে ঠিকমতো পানি ওঠেনা। সরবরাহ কমে আসে পৌরসভার পাইপ লাইনেও। এবার পদ্মায় পানি প্রবাহ কম থাকায় কুষ্টিয়া শহরে এ সংকট তীব্র হয়েছে। পদ্মার প্রধান শাখা গড়াই নদী বয়ে গেছে এই শহরের কোল ঘেঁষে। এই নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেছে। ১৯৯৬ সালে সাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি মোতাবেক নদীতে পানি কমে গেলে ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত ১০ দিন করে একেক দেশ ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে। অন্যদেশ পাবে অবশিষ্ট পানি। চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে ১১-২০ মার্চ, ১-১০ এপ্রিল এবং ২১-৩০ এপ্রিল। বাকী সময়গুলোতে ভারত পাবে গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি। সে অনুযায়ী এখন অর্থাৎ ২১-৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রাপ্যতার সময়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের নিবার্হী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, পানি চুক্তি মোতাবেক যে দশদিন ভারতের ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি রেখে অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশকে দিচ্ছে সেসময়ই মূলত পদ্মায় পানি কমে আসছে। শুকিয়ে যাচ্ছে গড়াই নদীও। একারণে এর অববাহিকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
এছাড়াও এই সময়ে পানি সংকটে বন্ধ রাখতে হচ্ছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জি-কে) সেচ প্রকল্প। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত এই পাম্প হাউজের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ২৬ মার্চ এবং ১৬ এপ্রিল দুই দফায় সেচ প্রকল্প জিকের প্রধান দুটি পাম্পের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। এখনো পাম্প বন্ধ আছে বলে ২৪ এপ্রিল দুপুর সোয়া ১২টায় জানান তিনি। এই প্রকল্পের খালের মাধ্যমেও পানি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের চার জেলায়। এতে ভূ-গর্ভের পানি রিচার্জ হয় বলেও জানান তিনি। গত কয়েক মাস বৃষ্টি নেই কুষ্টিয়া অঞ্চলে। গত সপ্তাহেও এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল তীব্র তাপপ্রবাহ। একারণেও পানি স্তর নেমে যায়। দুদিন হালকা বৃষ্টি হলেও তা তেমন কাজে আসেনি। তীব্র তাপপ্রবাহ কমলেও কাঙ্খিত মাত্রায় ভূ-গর্ভের পানির স্তর রিচার্জ হয়নি।
কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে নলকূপগুলো আগের মতোই অকেজো হয়ে আছে। কোনটিতে একেবারেই পানি উঠছে না। কোনটি আবার ভোর থেকে সকালের দিকে কিছুটা পানি ওঠে। তবে এক কলস পানি ভরতে গিয়ে নলকূপ চাপতে চাপতে কাহিল হয়ে পড়ছেন মানুষ। একই সঙ্গে পৌরসভার পাইপ লাইনে সরবরাহ পানিও কম আসছে। কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ার হাসি খাতুন বলেন, আমাদের টিউবওয়েলে পানি ওঠেনা। গরমের সময় খুবই পানির কষ্ট হয়। খাওয়ার পানির সমস্যা, গৃহস্থালি কাজের পানির সমস্যা, মাঝে মধ্যে ওজুর পানিরও সংকট হয়। এ বাসায় পৌরসভার পানির লাইন নেই। বাইরে থেকে পানি টেনে এনে সব কাজ সারতে হচ্ছে।
শহরের কোর্টপাড়ার গোসালা সড়কের মো. সুরুজ বলেন, খাবার পানি ও সাপ্লাই পানির সংকট এবার প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিনি বলেন, আমার এই এলাকার কোন টিউবয়েলেই পানি উঠছে না। দূর থেকে সবাই পানি আনছে। আমি আনছি গ্রাম থেকে। পৌরসভার সাপ্লাই পানিও সময়মতো আসছে না। দীর্ঘদিনের এ সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি।
একই কথা বলেন, বাবর আলী গেট এলাকার বাসিন্দা পরিবেশবাদী খলিলুর রহমান মজু। তিনি বলেন, চাপকলে পানি নেই। তিনি বলেন, নদীতে পানি না থাকায় ভূমিতে পানি নেমে গেছে। তিনি সাধারণ মানুষকে পানি অপচয় না করার আহ্বান জানান। বলেন, অনেক সময় দেখা যায় বোতল ভরতে গিয়ে তিনভাগ পানিই ফেলে দেন অনেকে।
কুষ্টিয়া শহর ছাড়াও মাঝে মধ্যেই ভেড়ামারা, কুমারখালী ও খোকসা শহরে নলকূল থেকে পানি না ওঠার মতো ঘটনা ঘটছে। পানি সংকটের আরেকটি কারণ তুলে ধরেছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহীম মোঃ তৈমুর। তিনি বলেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার পেছনে যত্রতত্র সাবমারসেবল (গভীর নলকুপ) পাম্প বসানোও দায়ী। তিনি বলেন, পৌর এলাকায় পাইপ লাইনের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল হলে এ সমস্যা এতো প্রকট হতো না। কিন্তু সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় মানুষ সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়েছে। শহর এলাকায় ঘণ ঘণ পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি তুলে আনায় স্তর দিনে দিনে নামছে। ভালমতো বৃষ্টি না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না- বলেন তিনি।
পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, গড়াইয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি পানির স্তর বিগত বছরগুলোর তুলনায় ৩২ ফুট নেমে যাওয়ায় হস্ত চালিত নলকুপ ও পাম্পে উঠছে না পানি। কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, সাধারণত ২৪ ফুট নিচে পর্যন্ত পানির স্তর থাকলে এই শহরে নলকুপ দিয়ে পানি ওঠে। পৌরসভা থেকেই এই শহরে বসানো আছে ৪হাজার ৩শ টিউবওয়েল। নাগরিকরা এর বাইরে নিজ উদ্যোগেও বসিয়েছে। এখানে ঠিকমতো পানি উঠছেনা। পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, পানির লেয়ার নিচে থাকায় আমাদের উৎপাদন ক্ষমতাও ৫০ ভাগ কমে গেছে। তিনি বলেন, আধাঘণ্টা পানি তুললেই স্তর নিচে চলে যাচ্ছে, আর পানি উঠছে না। তিনিও ভালমতো বৃষ্টির প্রত্যাশায় আছেন।
নদী বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এজাজ বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে নদীতে পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারত থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। অন্যদিকে সকল ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
Leave a Reply